টার্ম পেপার-রোহিঙ্গা সমস্যা ও সমাধান

রোহিঙ্গা সমস্যা ও সমাধান

প্রারম্ভিক কথা: রোহিঙ্গা সমস্যা বর্তমান বিশ্বেভ সবচেয়ে আলোচিত একটি ইস্যু। রোহিঙ্গারা পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী । ধর্মের বিশ^াসে এরা অধিকাংশই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক –তৃতীয়াংশ হলো রোহিঙ্গা। মায়ানমার সরকারের হিসাবমতে, প্রায় আটলক্ষ রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা আরাকানে বসবাস করে। রোইহঙ্গারা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন অনুযায়ী মায়ানমার নাগরিকদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।
১। পূর্ন নাগরিক (ঋঁষষ পরঃরুবহঃং)  যারা স্থায়ী ভাবে ১৮২৩ সালের পূর্ব থেকে বসবাস করে আসছে। পূর্বপুরুষ মায়ানমার অধিবাসী ছিলেন । জন্মগত ভাবে বার্মার নাগরিক।
২। সহযোগী নাগরিক ( অংড়পরধঃব পরঃরুবহঃং) যে সকল নাগরিক যারা ১৯৪৮ সালের ইউনিয়ন নাগরিক আইনের মাধ্যমে নাগরিক লাভ করেছেন।
৩। প্রাকৃতিক নাগরিক (ঘধঃঁৎধষরুবফ  পরঃরুবহঃং) ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী থেকে বসবাস করে আসছে এবং ১৯৮২ সালের পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছে।
১৯৮২ সালের আইন অনুযায়ী ১৩৫ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নাগরিকের স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের নাগরিক। মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। মায়ানমার সরকার তাদের ১৩৫ টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের তাদের অন্তর্ভূক্ত করেনি। মায়ানমার সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা হলো, বাংলাদেশী, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে। যদিও ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মায়ানমারে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব।
পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানী, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের সংমিশ্রণে উদ্ভব হয় এই সংকর জাতি যা ত্রয়োদশ-চতুর্থদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজ্য ছিল।
স্বাধীন আরাকান ও রোহিঙ্গা
স্বাধীন ও সমৃদ্ধ এক জনপদের নাম ছিলো আরাকান। বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম মোহনাবেষ্টিত আরাকান-ইয়োমা নামের দীর্ঘ পর্বতশৃঙ্গ আরাকানকে মায়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করেছে। আরাকানের প্রাচীন নাম ব্রহ্ম জনপদ, বর্তমানের রাখাইন, ইতিহাস বলছে, ১৪৩০-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২, ০০০ বর্গমাইল আয়তনের আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৮২৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তৎকালীন বার্মা দখল করার পর ১৮২৬ সালে আরাকান ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের অংশে পরিণত হয়। ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ বার্মা স্বাধীনতা লাভ করলে আরাকান স্থায়ীভাবে দেশটির অংশ হয়। ১৯৮১ সালে মায়ানমারের সামরিক জান্তা আরাকান রাজ্যে নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করে রাখাইন প্রদেশ। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশ প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে পূর্ব ভারত থেকে অস্ট্রিক জাতির একটি শাখা কুবুখ নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে। ক্রমান্বয়ে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, পাঠান এবং অষ্টম শতাব্দীতে আরবরা বঙ্গোপসাগরের উপকূলের বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। এই সকল নৃগোষ্ঠীর সংকরজাত রোহিঙ্গা। নবম-দশম শতাব্দীতে আরাকান রাজ্য ‘রোহান’ কিংবা ‘রোহাঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল। সেই অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের উদ্ভব। বস্তুত রোহিঙ্গারা আরাকান বা রাখাইনের একমাত্র ভূমিপুত্র জাতি।

রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত:
আরাকান রাজ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে রোহিঙ্গারা। তারা আরাকানে বহিরাগত নয়, বরং বর্মী রাজারাই আরাকানের দখলদার। মায়ানমারের সংবিধানে বুনিয়াদি জাতির যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাতেও রোহিঙ্গারা মায়ানমারের একটি বুনিয়াদি জাতি। কিন্তু সব ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ চাপা দিয়ে আর বাস্তবতা উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গারা মায়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বহিরাগত। বর্বর কর্মী সরকার বারবার এ অভিযোগ উত্থাপন করে যে, রোহিঙ্গারা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সদ্য অভিবাসিত একটি উপজাতি। অতএব, তাদেরকে স্থানীয় আদিবাসী গণ্য করে বর্মী শাসনতন্ত্র অনুযায়ী মায়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না। মূলত বার্মার প্রকৃত নাগরিক না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের বারবার দেশ থেকে বিতাড়নের ঘটনা ঘটছে। ব্রিটিশরা তৎকালীন ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠীর যে তালিকা প্রস্তুত করে তাতে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভূক্ত করেনি। আর এই থেকে সংকটের সূত্রপাত। উদ্ভূত এ সমস্যার পিছনে একক কোন কারণ নিহিত নয়, এর পিছনে রয়েছে আরো একাধিক কারণ ও ইতিহাস। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

আরাকানের পতন:
১০৪৪ সালে স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করে কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা আনাওহতা। তিনি মগদের বার্মা থেকে এনে দক্ষিনাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করেন। এরপর ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৬৬০ সালে আরাকানের রাজা চন্দ্র সুধর্মা কর্তৃক মোগল রাজপুত্র শাহসুজাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আরাকানের পতন শুরু হয়। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম পতনের পর আরাকান রাজ্য সংকুচিত হয়ে একটি ছোট অঞ্চলে পরিনত হয় এবং রাজনৈতিকভাবে বেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। ১৭৩১-১৭৮৪ সালেে মধ্যে আরাকান রাজ্যকে ১৩ জন রাজা শাসন করেন যাদের গড়শাসনকাল ২ বছরের বেশি ছিল না। আরাকানি সামন্ত রাজাদের মধ্যে কোন্দলের সুযোগ ১৭৮৫ সালের প্রথম দিকে মায়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এটি দখল করে বার্মার তথা মায়ানমার করদ রাজ্যে পরিনত করে।

বার্মার স্বায়ত্তশাসন:- ১৯৩৭ সালে বার্মাকে হোমরুল বা স্বায়ত্তবশাসন দেওয়া হয় এবং ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের বাদ দিয়ে বর্মীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। ফলে বার্মায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়্।ে  ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মধ্য ও দক্ষিন বার্মা বিশেষ করে আরাকানে প্রসংক্য দাঙ্গা- হাঙ্গামা সংঘটিত হয়। এতে প্রায় ১ ল্ক্ষ মুসলমান নিহত এবং রোহিঙ্গারা অনেকেই নিজ নিজ ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়। বিট্রিশদের তাড়াবার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বর্মীদের জাপানীদের পক্ষাবলম্বন করে। জাপানীদের আচরন আরো তিক্ততার মনে হলে তারা মত পরিবর্তন বিট্রিশদের সহায়তা করে। এর বিনিময়ে বার্মা ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারী স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৪২ সালে রোহিঙ্গা হত্যা:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ১৯৪২ সালে, জাপানিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা দখল করে নেয়। স্থানীয় রাখাইনরা এ সময় জাপানিদের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত জনগনকে আক্রমন করে। তাদের আক্রমনে শিকার হয় মূলত রোহিঙ্গা মুসলমানরা। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ রাখাইন অধ্যষুতি মিমবিয়া ও মোহাং টাউনশিপে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে রাখাইনরা।

রোহিঙ্গাদের পাল্টা প্রতিশোধ:-  রোহিঙ্গা হত্যার পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে রোহিঙ্গারা উত্তর রাখাইন অঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার রাখাইনকে হত্যা করে। সংঘাত তীব্র হলে জাপানিদের সহায়তায় রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের কোনঠাসা করে ফেলে। ১৯৪৫ সাল  পর্যন্ত মায়ানমার জাপানের দখলে থাকে। এ তিন বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা মায়ানমার ছেড়ে তৎকালীন বাংলায় চলে আসে। সে যাত্রা এখনো থামেনি। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা আবারও মায়ানমার দখল করে নেয়। এই দখল তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। বি্িরটিশরা এ সময় প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল যে সহায়তার বিনিময়ে উত্তর রাখাইনে মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি রাজ্য গঠন করে দেবে তারা। কিন্তু আরো অনেক প্রতিশ্রæতিও রাখেনি।
নে উইনের ক্ষমতা দখল:- ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক নে উইন মায়ানমারের ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা গ্রহণ পরবর্তী পর্যায়ে সেনাপ্রধান নে উইন রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন এবং ইতোপূর্বে  স্বীকৃতি অধিকার ও সুবিধাসমূহ বানচাল করে দেন। নে উইন বার্মার প্রচলিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বাতিল করে দেন। একমাত্র দল বার্মা সোশ্যাললিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির নেতৃত্বে দেশে সমাজতন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের কথা বলার যে সুযোগটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও তিরোহিত হয়।
১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন পাস :- ১৫ অক্টোবর ১৯৮২ সালে মায়ানমারের সামরিক জান্তা নাগরিকত্ব আইন প্রকাশ করে। এই আইনে মায়ানমারে তিন ধরনের নাগরিকত্বের বিধান রাখা হয় পূর্ণাঙ্গ, সহযোগী এবং অভিবাসী। এ নতুন আইনে বলা হয়, ১৮২৩ সালে মায়ানমারে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পরবর্তী সময়ে মায়ানমারে বাস করা ১৩৫টি গোত্রমুক্ত মানুষই মায়ানমারের পূর্নাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গন্য হবে। রোহিঙ্গাদের গোত্র হিসেবে অস্বীকার করে সামরিক সরকার  ‘আইনে সহযোগী নাগরিক’ হিসেবে শুধু তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। যারা ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব অ্যাক্ট ইত্যেমধ্যেই আবেদন করেছে। এছাড়া অভিবাসী নাগরিক হিসেবে কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেক করা হয়। সেগুলো যথাযোগ্যভাবে প্রমানসাপেক্ষ বলে বলা হয়। যারা মায়ানমারের স্বাধীনতার আগে ( ৪ জানুয়ারী ১৯৪৮) এ দেশে প্রবেশ করেছে। মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় ভাষায় দক্ষ এবং যাদের সন্তান মায়ানমারে জন্মগ্রহন করেছে, তারাই এ ধারায় নাগরিক্তব দিতে পারে।
নাগরিক কার্ড থেকে বঞ্চিত:- ১৯৮৯ সাল থেকে মায়ানমার তি ধরনের নাগরিক কার্ডের প্রচলন করে। পূর্ণাঙ্গ নাগরিকদের জন্য গোলাপী, সহযোগী নাগরিদের জন্য নীল এবং অভিবাসী নাগরিকদের জন্য সবুজ রঙ্গের কার্ড দেয়া হয়। চাকরি, ব্যবসা- বাণিজ্য পড়াশোনা- চিকিৎসা সেবাসমূহ সব ধরনের কাজকর্মে এ কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কোন ধরনের কার্ড দেওয়া হয় না। এর ফলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মায়ানমার টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ে।
নির্দিষ্ট গ্রামে বন্দি :- মায়ানমার জান্তা রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না আর তাই ‘বহিরাগত’ হিসেবে চিহ্নিত এসব রোহিঙ্গাকে রাখা হয়েছে কারাগারে। না, আট লাখ রোহিঙ্গাকে বন্দি করার মতো বড় কারাগার মায়ানমার তৈরি করতে পারেনি। তাই রোহিঙ্গারা নিজ গ্রামে বন্দি। মায়ানমারের অন্যকোন অঞ্চলে যাওয়ার কথা তো দুরূহ। পাশের গ্রামে যাওয়ার ও কোনো অনুমতি নেই তাদের। নিজ গ্রামের বাইরে যেতে হলে তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকার কাছ থেকে  ট্রাভেল পাস নিয়েই তারা গ্রামের বাইরে যেতে পারে। কিন্তু ট্রাভেল পাস পাওয়া কঠিন বিষয়। এ জন্য নাসাকাকে দিতে হয় বড় অংকের ঘুষ। তার পরেও রক্ষা নেই। যদি ট্রাভেল পানে উল্লিখিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজ গ্রামে ফিরতে ব্যার্থ হয় কোনো রোহিঙ্গা, তাহলে তার নাম কাটা যায় এ গ্রামের তালিকাভূক্ত থেকে সে তখন নিজ গ্রাম নামের কারাগারেও অবৈধ হয়ে পড়ে। তাদের ঠাঁই হয় জান্তা সরকারের জেলখানায়।
রোহিঙ্গাদের বিয়েতে বাঁধা :- ১৯৯০ সালে আরাকান রাজ্যে স্থানীয় আইন জারি করা হয়। আইটিতে উত্তর আরাকানে বাস করা মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিয়ের আগে সরকারি অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক।
জন্মনিয়ন্ত্রন বাধ্যতামূলক :- ২০০৫ সালে নাসাকা বাহিনী পূর্ণগঠন করা হয়। এ সময় দীর্ঘ দিন বিয়ে সংক্রান্ত আবেদন গ্রহন করা বন্ধ করে দেয় নাসাকা। পরের বছর যখন আবার আবেদন গ্রহন চালু হয়। তখন নিয়মকে করা হয় আরো কঠোর। তখন থেকে আবেদনের সাথে নবদম্পতিকে  মুচলেকা দিয়ে বলতে হয় যে এ দম্পতি দুইয়ের অধিক সন্তান নেবে না।
চিকিৎসা ও শিক্ষায় সীমিত অধিকার :- রোহিঙ্গাদের জন্য মায়ানমারের নাগরিক অধিকার অনেক দূরের ব্যাপার। সরকারি চাকুরি তাদের জন্য নিষিদ্ধ। উত্তর আরাকানের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রাখাইন এবং বার্মিজ নাগরিকরা স্থানীয় রাখাইন ভাষায় কথা বলার কারনে রোহিঙ্গারা সেখানে গিয়ে পূর্ণ চিকিৎসা সেবা নিতে পারে না। সরকারি বড় হাসপাতালে তাদের প্রবেশ পদ্ধতিগতভাবে নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা গুলো পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ নিতে পারে না। এমনকি রোহিঙ্গা মহিলাদের জরুরি ধাত্রীবিদ্যা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েও মায়ানমার সরকারের কাছে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে সেবা সেবা সংস্থা গুলো।
রোহিঙ্গা শরনার্থী ও বাংলাদেশ:- মায়ানমারের ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্গনের শিকার হয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আসা শুরু করে। সর্বশেষ ২৫ আগষ্ট-২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী সাড়ে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ২৫ আগষ্ট ২০১৭ থেকে মায়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে যে, সামরিক অভিযান শুরু করে তার নামকরন করা হয় ‘অপারেশন ক্লিয়ারেন্স’। এ অভিযানে মায়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কুখ্যাত যুদ্ধকৌশল   ঞযৎবব অষষ চড়ষরপু  অনুসরণ করে। এ কৌশলের মূরকথা সবাইকে হত্যা করো, সব কিছু পুড়িয়ে দাও, সবকিছু লুট করো। এরপর থেকে সর্বশেষ ঢলের আসা শরনার্থী বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থীর বর্তমান সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক। রোহিঙ্গাদের মূল ভূ-খন্ড রাখাইনের চেয়েও বেশি।

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী :- মায়ানমারের শাসকগোষ্ঠী ও বর্ণবাদীদের দ্বারা রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু হয় ১৭৮৪ সালে। এরপর ধারাবাহিগকভাবে ১৯৪২, ১৯৭৮, ১৯৯২ এবং সাম্প্রতিক সময়ে কোনো একটি কারণ তৈরী করে তারা রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে। মূলত ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গারা মায়ানমার ছাড়তে শুরু করে। আর গত চার দশক ১৫-২০ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছে অন্যত্র। দেশ ছাড়া এ সকল রোহিঙ্গাদের প্রথম পচন্দ হলো, বাংলাদেশ। এছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা। শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা রিলিফওয়েব এবং সংশ্লিষ্ট দেশের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে প্রায় ২৮ লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা দেশ অনুযায়ী রোহিঙ্গা জনসংখ্যা।

দেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী :-
দেশের নাম    রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী
০১. বাংলাদেশ    ১৩০০০০০
০২. সৌদি আরব    ৫০০০০০
০৩. মায়ানমার    ৪০০০০০
০৪. পাকিস্তান    ৩৫০০০০
০৫. সংযুক্ত আরব আমিরাত    ৫০০০০
০৬. ভারত    ৪০০০০
০৭. যুক্তরাষ্ট্র    ১২০০০
০৮. থাইল্যান্ড    ৫০০০
০৯. ইন্দোনেশিয়া    ১০০০
১০. জাপান    ৩০০
১১.নেপাল    ২০০
১২. কানাডা    ২০০
১৩. আয়ারল্যান্ড    ১০৪
১৪. শ্রীলংকা    ৩৬

 রোহিঙ্গা ইস্যু, ২০১২ :- দুই তিনজন রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারী এক রাখাইন নারীকে ধর্ষন ও হত্যাকে কেন্দ্র করে জুন,২০১২ তে শুরু হয় রাখাইনে – রোহিঙ্গা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক পর্যায়ে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধ মৌলবাদীরা মিলে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত ধোলাই শুরু করে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ছাড়া নিপীড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ সরকারের নতুন করে আরো রোহিঙ্গা শরনার্থী গ্রহনের অনিচ্ছার কারনে উদ্বাস্ত রোহিঙ্গারা ন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে না। তবে, বাংলাদেশ সরকার বিজিবির মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের  যতটুকু সম্ভব মানবিক সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু দূর্গম সীমান্ত দিয়ে ঠিকই হাজার নিপীড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।
রোহিঙ্গা গণহত্যা ২০১৭:- ২৫ আগষ্ট ২০১৭ সংঘটিত কথিত সন্ত্রাসী হামলার জবাবে উত্তর রাখাইনে ভয়ংকর ঝপড়ৎপযবফ ঊধৎঃয  বা পোড়ামাটি নীতিতে অভিযান চালায় মায়ানমার সেনাবাহিনী। এতে রাখাইনে সেনা ও মগদের হাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়। রাখাইনের মংড়–, বুথিয়াড়ং ও রাথেদং শহরতলিতে মোট ৪৭১টি গ্রামের মধ্যে নিশিচহ্ন হয়ে যায় ২১৪টি গ্রাম। ঐ তিনটি শহরতলিই ছিল রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। সাম্প্রতিক নিধন ও বিতাড়নের প্রধান শিকার ছিল এসব অঞ্চল । গ্রামের পর গ্রাম এমনভাবে জ¦ালিয়ে ও গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে সেখানে মানব বসতির  কোন চিহ্নই না থাকে। রাখাইনে ‘ অপারেশন ক্লিয়ারেন্স’ নামের এ অভিযানে মায়ানমার সেনাবাহিনী ভয়ানক ভাবে মানবাধিকার লঙ্গন করে। নির্বিচারে হত্যা, শিরচ্ছেদ, লোক জনকে ঘরে বন্দি করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা ও ধর্ষনের মতো বর্বর ঘটনা ঘটায় তারা। এমনকি শিশুররাও সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী, সরকার সমর্থক সশস্ত্র গোষ্ঠী ও দাঙ্গাবাজদের সহিংস আক্রমন থেকে রেহাই পায়নি।
রোহিঙ্গা সংকট ও বিশ্ববিবেক:-শুরু থেকেই মায়ানমার সেনাদের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক অভিযানকে ‘গণহত্যা’ ( এবহড়পরফব)  আর ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করে বিশ্বের ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট থেকে বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেয়া এক বক্তৃতায়  ঞযব ড়ভভরপব ড়ভ ঁহরঃবফ ঘধঃরড়হ ঐরময পড়সসরংংরড়হবৎ ভড়ৎ ঐঁসধহ জরমযঃং (ঙঐঈঐজ) এর প্রধান জাইদ রাদ আল হুসেইন বলেন, মায়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর পরিকল্পিত নির্যাতনের মাধ্যমে জাতিগতভাবে তাদের নির্মূল অভিযানের নৃশংস উদাহারণ বলে অভিহিত করেন। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘও রাখাইনে জাতিগত নিধন যজ্ঞ চলছে বলে বিৃতি দেয়। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মত বিবৃতি প্রদান করে। এর মাধ্যমে ৯ বছর পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মতৈক্যে পৌঁছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত:-  মায়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যা- নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের সমন্বয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব মায়ানমারের প্রতি তিনটি আহŸান জানান
আহŸান তিনটি হলো যথা-
১. শরনার্থীদের নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে দেয়া।
২. বাঁধাহীন ত্রান পৌঁছানো।
৩. অবিলম্বে রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ করা।
নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার মূল বক্তব্য:- ১. কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে সব সদস্য।
২. শান্তিরক্ষী পাঠানো বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব আসেনি।
৩. রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার বিপর্যয় ঘটেছে।
৪. জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সেখানে যেতে দিতেহবে।
৫. সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের জন্য মায়ানমার ও বাংলাদেশ, এই  দুই প্রতিবেশী দেশকেই সমঝোতার ভিত্তিতে একযোগে কাজ করতে হব্
ে৬. ইউরোপীয় ইউয়িনের ২৮টি দেশের পার্লামেন্ট ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ‘মায়ানমার বিশেষ করে রোহিঙ্গা পরিসিইত শীর্ষক আলোচনা শেষে ২০ দফা প্রস্তাব গ্রহন করে।
 আন্তর্জাতিক গণ আদালত ও বিচার :- রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে স্থাপিত রোম- ভিত্তিক চবৎসধহবহঃ চবড়ঢ়ষবং ঞৎরনঁহধষ (চচঞ)  নামের এক গণ আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক খ্যাসিম্পন্ন সাত বিশেষজ্ঞের একটি প্যানেল অংশ নেয়। পাঁচ দিনের বিচারকার্যে বিচারকরা প্রসিকিউশনের যুক্তি -তর্ক, বিশেষজ্ঞদের মতামত , ভূক্তভোগীদের জবানবন্দি বিচার বিশ্লেষন করেন। শুনানিতে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও অংশ নেন। ট্রাইব্যুনালে রোহিঙ্গা, কারেনসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় অপরাধের বর্ণনা দেন। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাত সদস্যের বিচারক প্যানেলের সভাপতি আর্জেন্টিনার সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা দানিয়েল  ফিয়েরেস্তেইন গণআদালতের ‘প্রতীকি রায়, ঘোষণা করেন। সামরিক বাহিনী, পলিশ, অন্যান্য বৌদ্ধ মিলিশিয়া ও দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ:-
আনান কমিশন ও সুপারিশ :- বৈশ্বিক সমালোচনার মুখে মায়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি ২৪ আগষ্ট ২০১৬ রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতির উন্নয়নে গঠন  করেন ‘রাখাইন উদেষ্টা কমিশন’ জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও নোবেল শান্তি পুরুস্কারে ভূষিত ঘানার নাগরিক কফি আনানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশন ‘আনান কমিশন’ নামে পরিচিতি পায়। এ কমিশনের ৬ জন সদস্যই ছিলেন মায়ানমারের নাগরিক। ২৪ আগষ্ট ২০১৭ কমিশন এর প্রতিবেদন পদান করে। কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ৮৮টি সুপারিশ করে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
* রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং মায়ানমার ও বাংলাদেশ মিলে যৌথ যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নিরাপদে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসন করতে হবে।
* ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে।
* মায়ানমারের নাগরিকত্ব আইটি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নাগরিকত্ব ও জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
* জাতি – ধমর্ – বর্ণ নির্বিশেষে সবার অবাধ চলাচলের সুযোগ দিতে হবে।
* মায়ানমারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
* সীমান্ত ইস্যু সমূহ অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ মায়ানমার সুসম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
* আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মায়ানমারে প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে দেওয়া এক বিবৃতির মাধ্যমে গঠন করা হয় ১৫ সদস্যের ‘ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি অব রাখাইন অ্যাডভাইজারি কমিটি।”
বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব :-
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের ভাষন রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দ্রæত কার্যকর উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘের এবং আনতর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহŸান জানান। তিনি অবিলম্বে মিয়ানমারের সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নি:শর্ত ভাবে বন্ধ করে শান্তি ও স্থিতিশলিতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ৫ টি প্রস্তাব দেশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ প্রস্তাব:-
ক্স    অনতিলম্বে ও চিরতরে মায়ানমারে সহিংসা ও ‘জাতিগত নিধন’ নি:শর্তে বন্ধ করা।
ক্স    অনতিলম্বে মায়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব অনুসন্ধানী দল পাঠানো।
ক্স    জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে মায়ানমারের ভেতরে জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা।
ক্স    রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া সব রোঙ্গিাকে মায়ানমারে তাদের নিজেদের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুর্ণবাসন নিশ্চিত করা।
ক্স    কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নি:শর্ত, পূর্ণ এবং দ্রæত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রোঙ্গিাদের যা যা করণীয়:-
ক্স    রোহিঙ্গা জাতিকে একটি কার্যকরী পরিষদ গঠন করা এবং তার অধীন একতা বদ্ধ হওয়া।
ক্স    সেই কার্যকরী পরিষদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোঙ্গিাদের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করা।
ক্স    সকল রোহিঙ্গার একটি ডাটাবেজ তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ক্স    রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও প্রাথমিক চাহিদাপূরণে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা ও তার ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘের সাথে একযোগে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহন করা।
ক্স    আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালতে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ।
ক্স    বিশ্বেজনমত সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা ও কর্মসূচি হাতে নেওয়া।
ক্স    আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনকেগুলোকে প্রভাবিত করা যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনগুলো মায়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ দেয়।

 
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের যা যা করণীয় হতে পারে:-
ক্স    আর কোন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেওয়া।
ক্স    যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে, তাদের তালিকা তৈরী করা ও কড়া নজরদারীর ব্যবস্থা করা রোহিঙ্গা নীতিমালা প্রণয়ন করা। যার মাধ্যমে উদ্বাস্ত রোহিঙ্গাদের কি কি সুবিধা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থাকতে কি কি বিধিমালা মেনে চলতে হবে, তার উল্লেখ থাকবে।
ক্স    যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে  আছে, তাদের পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনের সহায়তায় মায়ানমারে পেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এছাড়া রোহিঙ্গা রিফিউজিদের তৃতীয় কোন কোন দেশে প্রেরণের বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানো।
ক্স    আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়ভাবে মায়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার এবং আরাকানের উত্তরাঞ্চলে স্বায়ত্ত¡শাসন দেওয়া।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সম্প্রদায়ের করণীয় হতে পারে:-
ক্স    রোহিঙ্গা উদ্বাস্তদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রেরণ করা।
ক্স    মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে করে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব প্রদান করে।
ক্স    আরাকানের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বায়ত্ত¡শাসন ব্যবস্থা করা।
ক্স    রোহিঙ্গা উদ্বাস্তদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
ক্স    রোহিঙ্গাদের জন্য পূর্ণাজ্ঞ পূর্নবাসন কর্মসূচী হাতে নেওয়া।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মায়ানমারের যা যা করনীয়:-
ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থায়ী অধিবাসী তাই, মায়ানমার সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের পূর্ণাজ্ঞ নাগরিকত্ব প্রদান করা।
রোহিঙ্গাদের জন্য কমপক্ষে পঁচিশ বর্ষব্যাপি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।
মায়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য যে গ্যাটোগুলো আছে, সেগুলোর অবসান ঘটিয়ে রোহিঙ্গাদের পূণৃবাসন দেয়া।
বিভিন্ন রাষ্ট্রে ( বিশেষত : বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সৌদিআরব) যে সকল রোহিঙ্গা উদ্বাস্ত আছে, তাদের মায়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে পূর্ণবাসন দেয়া। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামপ্্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা।
উপসংহার : – পরিশেষে বলা যায় যে, সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সংকট হলো রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘসহ বিশ্বনের্তৃত্ব বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও এখন পর্যন্ত রাশিয়া, ভারত ও চীন ে সংকট সমাধানে কার্যকরভাবে এগিয়ে আসেনি। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের বেশি ভূক্তভোগী তাই তাকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যাতে আনান কমিশনের সুপারিশ, প্রধানমন্ত্রীর ৫ দফা প্রস্তাব এবং নিরাপত্তা পরিষদের আহŸানে মায়ানমার সাড়া দিয়ে চলমান অবস্থার অবসান ঘটায়। অন্যথায় এটি আরো বড় আকার ধারণ করবে।

 
তথ্যসূত্র / গ্রন্থপুঞ্জি:-
ক্স    রোহিঙ্গা: ইতিহাস, সমস্যা সমাধান। সচলায়তন. পড়স
ক্স    রোহিঙ্গা  সমস্যা সমাধান – উইকিপিডিয়া বাংলা
ক্স    রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পৃক্ত কলা – প্রথম আলো
ক্স    রোহিঙ্গা  সমস্যা সমাধান – ঔধমড়হবংি২৪.পড়স
ক্স    রোহিঙ্গা  সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ  –  ইইঈ ঘবংি  বাংলা
ক্স    রোহিঙ্গা সংকট —-  িি.িফ.িপড়স
ক্স    রোহিঙ্গা  সমস্যা সমাধান  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় –  ইত্তেফাক
ক্স    রোহিঙ্গা  সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক দেশগুলোর ভূমিকা – কালের কন্ঠ
ক্স    রোহিঙ্গা  : নি:সজ্ঞ নিপীড়িত জনগোষ্ঠী- লেখক মো: এমদাদুল ইসলাম, প্রকাশক – প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশ কাল – জানুয়ারী ২০২০।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x
error: Content is protected !!